আমেরিকার ঘুম ওড়াতে আসছে রুশ সাবসনিক ‘মেসেঞ্জার’ 

6
রুশ সাবসনিক ‘মেসেঞ্জার’ 

বাজপাখির মতো দেখতে কার তৈরি নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমান আগামী দিনে বদলে দেবে লড়াইয়ের রং? এই নিয়ে ইতিমধ্যেই কাটাছেঁড়া শুরু করে দিয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। আকাশের ‘দখলদারি’ নিয়ে দুই পরমাণু শক্তিধরের মধ্যে ফের শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। নতুন বোমারু বিমান প্রকাশ্যে এনে একে অপরকে চমকে দিতে চাইছে তারা। বায়ুশক্তির প্রতিযোগিতায় নামা দুই মহাশক্তিধর হল আমেরিকা ও রাশিয়া। দু’জনের কাছেই রয়েছে কৌশলগত বোমারু বিমান। এর সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়িয়ে চলেছে মস্কো এবং ওয়াশিংটন। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের বোমারু বিমানকে বায়ুসেনায় সামিল করার দিকেও নজর দিয়েছে ওয়াশিংটন ও মস্কো। এর জেরেই খবরের শিরোনামে এসেছে ‘বি-২১’ এবং ‘পাক ডা’ রুশ সাবসনিক ‘মেসেঞ্জার’ ।

 

২০২৩ সালের নভেম্বর ‘বি-২১’কে প্রথম বার আকাশে ওড়ায় আমেরিকা। এটির নকশা এবং নির্মাণের নেপথ্যে হাত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা নর্থরপ গ্রুমম্যানের। লম্বা দূরত্ব পেরিয়ে শত্রুব্যূহে ঢুকে ‘কার্পেট বম্বিং’ করার ক্ষমতা রয়েছে এই ‘স্টেলথ’ লড়াকু উড়োজাহাজের।

 

অন্য দিকে রাশিয়ার তৈরি ‘পাক ডা’ এখনও মাটি ছেড়ে আকাশে ওড়েনি। চলতি বছরে মস্কো এই বোমারু বিমান প্রকাশ্যে আনবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিছু দিন আগে ‘পাক ডা’র নকশা দুনিয়ার সামনে নিয়ে আসে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। সেটি দেখার পরই বিশ্ব জুড়ে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়।

 

বর্তমানে আমেরিকার বায়ুসেনা নর্থরপ সংস্থার তৈরি ‘বি-২ স্পিরিট’ নামের একটি বোমারু বিমান ব্যবহার করে। সেগুলির বদলি হিসাবে ‘বি-২১’কে ফৌজে সামিল করা হবে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন। প্রসঙ্গত, এই বোমারু উড়োজাহাজের উৎপাদন এখনও ব্যাপক আকারে শুরু করেনি আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’।

 

একই রকমের পরিকল্পনা রয়েছে রুশ বায়ুসেনারও। তাঁদের হাতে রয়েছে গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে টুপোলেভ সংস্থার তৈরি ‘টিইউ-৯৫ বিয়ার’ নামের বোমারু উড়োজাহাজ। ‘পাক ডা’-এর নির্মাণকাজ শেষ হলে সেগুলিকে পুরোপরি বদলে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে ক্রেমলিনের।

 

‘বি-২১’ বোমারু বিমানের সাঙ্কেতিক নাম ‘রাইডার’ রেখেছে আমেরিকার বায়ুসেনা। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি ষষ্ঠ প্রজন্মের বোমারু বিমান। বোমারু উড়োজাহাজটির নকশা বেশ অদ্ভুত। এর লেজের অংশ প্রায় নেই বললেই চলে। বিমানটির পাখা চওড়া এবং ত্রিভুজাকার।

 

রুশ বায়ুসেনা আবার ‘পাক ডা’র সাঙ্কেতিক নাম দিয়েছে ‘মেসেঞ্জার’ বা বার্তাবাহক। নির্মাণকারী সংস্থা টুপোলেভ জানিয়েছে, সাবসনিক গতিতে (শব্দের চেয়ে কম গতিবেগ) উড়তে পারবে তাঁদের নতুন প্রজন্মের বোমারু উড়োজাহাজ। ১২ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে যে কোনও জায়গায় হামলা চালাতে পারবে ‘পাক ডা’।

 

আমেরিকার ‘বি-২১ রাইডার’ প্রথাগত এবং পরমাণু— দু’ধরনের হাতিয়ার বহনে সক্ষম। এর পাশাপাশি বোমারু উড়োজাহাজটি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলাও চালাতে পারবে যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুসেনা। ০.৮ ম্যাক গতিতে ছুটতে পারা ‘বি-২১ রাইডার’ মাটি থেকে ৫০ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে সক্ষম। ফলে সহজে একে চিহ্নিত করতে পারবে না কোনও রাডার।

 

একটানা ওড়ার নিরিখে আবার ‘বি-২১’কে মাত দেবে রুশ ‘পাক ডা’। এক বার জ্বালানি ভরে টানা ৩০ ঘণ্টা বোমারু উড়োজাহাজটি উড়তে পারবে বলে স্পষ্ট করেছে নির্মাণকারী টুপোলেভ। পরমাণু এবং প্রথাগত মিলিয়ে মোট ৩০ টন বোমা বহনে সক্ষম হবে রুশ ‘মেসেঞ্জার’।

 

ইউরেশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রুশ ও আমেরিকার নতুন প্রজন্মের এই দুই বোমারু বিমান ইলেকট্রনিক যুদ্ধে বেশ পটু। শত্রুপক্ষের রাডারকে জ্যাম করা বা ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’কে (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) উড়িয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত এই ‘বি-২১ রাইডার’ ও ‘পাক ডা মেসেঞ্জার’। রুশ বোমারু উড়োজাহাজটিকে ওড়াতে মোট চার জন পাইলট লাগবে বলে জানা গিয়েছে।

 

একটা সময়ে বোমারু বিমানের বহরকে ছোট রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমেরিকা। আর তাই প্রাথমিক ভাবে ১৩২টি ‘বি-২ স্পিরিট’ নির্মাণের কথা থাকলেও এটি মাত্র ২১টি তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু চিনের ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধিতে সেই সিদ্ধান্ত থেকে ওয়াশিংটন সরে এসেছে বলে স্পষ্ট করেছেন সে দেশের বায়ুসেনা সচিব।

 

সূত্রের খবর, গত বছর (পড়ুন ২০২৪) ‘বি-২১ রাইডার’ নির্মাণের বরাত দেয় পেন্টাগন। সেই কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে নর্থরপ। প্রথম পর্যায়ে এই শ্রেণির পাঁচটি বোমারু বিমান আমেরিকার বায়ুসেনার হাতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি তুলে দেবে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। চলতি বছরের মাঝামাঝি বিমানগুলি পেতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশযোদ্ধারা।

 

আমেরিকার প্রতিরক্ষা দফতরের সাবেক শীর্ষকর্তা উইলিয়াম লাপ্ল্যান্ট জানিয়েছেন, ভবিষ্যতের বড় যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে বি-২১ নির্মাণের বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। ১০০টি এই ধরনের বোমারু বিমান তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতির উপর বিচার করে এই সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে।

 

বর্তমানে আমেরিকার বায়ুসেনা বিভিন্ন ধরনের বোমারু বিমান ব্যবহার করছে। সেই তালিকায় বি-২ স্পিরিট ছাড়াও রয়েছে রকওয়েল বি-১ ল্যান্সার। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এই বোমারু উড়োজাহাজগুলি ব্যবহার করা হবে বলে স্পষ্ট করেছে পেন্টাগন। তবে বি-১ ল্যান্সারের জায়গা বি-২১ রাইডার নেবে কি না, তা জানা যায়নি।

 

রুশ বায়ুসেনার অস্ত্রাগারে আবার রয়েছে টিইউ-১৬০ হোয়াইট সোয়ান এবং টিইউ-২২এম নামের দু’টি বোমারু বিমান। এর মধ্যে টিইউ-১৬০ আকারে বিশ্বের অন্যতম বড় বোমারু উড়োজাহাজ। তাসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মস্কোর এক সেনাকর্তা জানিয়েছেন, পাক ডা (রুশ সাবসনিক ‘মেসেঞ্জার’ ) বাহিনীতে সামিল হলেও এগুলির ব্যবহার এখনই বন্ধ করছেন না তাঁরা।

 

ভারতীয় বিমানবাহিনীতে কোনও বোমারু বিমান নেই। কয়েক বছর আগে ‘টিইউ-১৬০ হোয়াইট সোয়ান’ নয়াদিল্লিকে বিক্রির ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল রাশিয়া। এ ব্যাপারে কথাবার্তা কত দূর এগিয়েছে, তা জানা যায়নি।

 

চলতি বছরের জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়েই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নয়াদিল্লির আরও বেশি করে আমেরিকার থেকে অস্ত্র কেনা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। সেখানে বোমারু বিমান নিয়ে কোনও কথা হয় কি না, সেটাই এখন দেখার।